প্রকাশিত: ০৫/০৯/২০১৬ ৮:১০ এএম , আপডেট: ০৫/০৯/২০১৬ ৮:১১ এএম

04c92d4563fbc95441e562cddb69834b-04-09-16-PIC-MR-KHANমিজানুর রহমান খান:: শান্তিতে নোবেলজয়ী ও গণতন্ত্রের মানসকন্যা অং সান সু চি রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশিদের মনোবেদনার কারণ হয়ে আছেন। তা সত্ত্বেও জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর প্রাথমিক উদ্যোগের জন্য তাঁকে অভিবাদন। ১৯৪৭ সালের পরে এই প্রথম দেশটির সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, যারা দীর্ঘকাল ধরে আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সশস্ত্র লড়াই করে আসছে, তাদের সঙ্গে সরকার একটি শান্তি সম্মেলন শেষ করল। রোহিঙ্গাদের এতে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তবে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে রোহিঙ্গা সমস্যাকে সু চি ভুলে থাকতে চাননি। সে কারণে তিনি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও নোবেল পুরস্কারে ভূষিত কফি আনানের নেতৃত্বে একটি রাখাইন উপদেষ্টা কমিশন গঠন করেছেন। তাঁদের মূল কাজ হলো আরাকান সংকটের অবসান ঘটানো। আমরা এই কমিশনের সাফল্য কামনা করি। এমনকি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলব এই কমিশনকে আমন্ত্রণ জানানো যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে। বিশেষ করে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের যেসব স্থানে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা আছে, তাদের শিবির পরিদর্শন করতে আনান কমিশনকে আমন্ত্রণ জানানোটাই সমীচীন হবে।
বন্ধুপ্রতিম মিয়ানমার, বিশেষ করে যেখানে এখন গণতন্ত্রের মানসকন্যা নেতৃত্বে আসীন, তিনি যে উচ্চপর্যায়ের একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠন করেছেন, তাঁকে একজন নাগরিক হিসেবে দ্বিধাহীন চিত্তে বাংলাদেশে স্বাগত জানাই। কারণ, মিয়ানমার সরকারের ওয়েবসাইটে ওই কমিশনের যে কার্যপরিধি দেখলাম তাতে কমিশনের বাংলাদেশ সফরও প্রত্যাশিত। এতে বলা হয়েছে, ‘কমিশন সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের মতামত গ্রহণ করবে। কমিশন পরিস্থিতির আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেবে। এমনকি সেটা করতে গিয়ে তারা তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনায় নেবে, যারা ইতিমধ্যে বিদেশে উদ্বাস্তুর মর্যাদা গ্রহণ করেছে।’ রোহিঙ্গা প্রশ্নে সু চির এনএলডি রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের বাঙালি চিহ্নিত করে আমাদের স্তম্ভিত করেছে। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পরে গত সপ্তাহে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন প্রকাশ্যে মিয়ানমারের এই অবস্থানকে নাকচ করে দিয়েছেন। গত সোমবার মিয়ানমার সফররত বান কি মুন বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি কেবল তাদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন নয়। এই মানুষগুলো অনেক প্রজন্ম ধরে এ দেশে বাস করছে। দেশের অন্য নাগরিকেরা নাগরিকত্ব বা যে আইনি স্বীকৃতি পায়, তাদেরও তা পাওয়ার অধিকার আছে।’
সু চি তাঁর এনএলডির নেতা-কর্মীকে পরামর্শ দেন যে তাঁরা যেন ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ না করেন। এর পরিবর্তে এনএলডি প্রশাসন তাদের ‘রাখাইনের মুসলিম’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। কিন্তু ‘রাখাইনের মুসলিম’ হিসেবেও একটি গণতান্ত্রিক সমাজে যেটুকু অধিকার ন্যূনতম, সেটা তারা ভোগ করতে পারছে না। আমরা সু চির কাছে মানবিক মিয়ানমারের বিনির্মাণ আশা করি। সতর্কতার সঙ্গে হলেও কফি আনানের নেতৃত্বে যে বিশেষ কমিশন হয়েছে, তাকে আমরা ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখি। কারণ, আরাকান ও মিয়ানমারের রাজনীতির যে প্রভাবশালী মহল রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে মানে না, তারা সবাই একযোগে সু চির কফি আনান কমিশন গঠনের তীব্র বিরোধিতা করছে। কিন্তু সু চি এখন পর্যন্ত এই কমিশন যাতে ভালোভাবে কাজ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে সংকল্পবদ্ধ।
গত ২৪ আগস্ট রয়টার্সের রিপোর্টে পড়েছি, নয় সদস্যের কমিশনে মুসলিম সদস্যরাও থাকবেন। মনে হয়েছিল রোহিঙ্গাদেরও বুঝি রাখা হবে। কিন্তু পরে সেই ভুল ভাঙল। কোনো রোহিঙ্গাকে রাখা হয়নি। তবে সেই ঘাটতি পূরণ করতে সু চি হয়তো একটি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়। নয় সদস্যের কমিশনে কফি আনান ছাড়া আরও দুজন বিদেশিকে রাখা হয়েছে। তাঁদের একজন মুসলিম। জানি না তাঁর মুসলিম পরিচয় তাঁকে বাছাইয়ে কোনো বিবেচনা কাজ করেছে কি না। তিনি হলেন লেবাননের সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী ঘাসান সালামে। ২০০৩-২০০৬ সালে তিনি জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত হিসেবে কাজ করেছিলেন। তৃতীয় বিদেশি সদস্য হলেন ব্রিটেনে নেদারল্যান্ডসের সাবেক রাষ্ট্রদূত (২০১২-২০১৫) মিজ লেতিতা ভ্যান দেন অ্যাসেম। বাকি ছয়জনের মধ্যে মিয়ানমারের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানসহ আরও একজন সদস্য আছেন। আরও আছেন রেডক্রস সভাপতি, রিলিজিয়ান্স ফর পিস নামের একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, মিয়ানমার একাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্সের একজন সদস্য এবং রাখাইন মহিলা সমিতির ভাইস চেয়ারপারসন। এটাও লক্ষণীয় যে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি ছাড়া যে দেশের কোথাও কিছুই হয় না, সেখানে এই কমিশনে সামরিক পদমর্যাদার কাউকে রাখা হয়নি। এমনকি এটাও দেখার বিষয় যে কফি আনান কমিশনের কার্যক্রম শুরু করার ঠিক আগ মুহূর্তে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন পরিষ্কার করেই বললেন, যুগ যুগ ধরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। আর সেটা আবার সংবাদ সম্মেলনে এবং অং সান সু চির উপস্থিতিতে। সু চি অবশ্য কোনো মন্তব্য করেননি। সু চি বর্তমানে সরকারের উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
প্যাংলংয়ে ৪ সেপ্টেম্বর শান্তি সম্মেলন শেষ হওয়ার পরদিন অর্থাৎ আজ ৫ সেপ্টেম্বরেই কফি আনানের ইয়াঙ্গুন পৌঁছানোর কথা। আরাকানের রাজ্য প্রশাসন ইঙ্গিত দিয়েছে যে চলতি সপ্তাহে আনান কমিশন আরাকান সফর করতে পারে। আগামী এক বছর কাজ করার পর এই কমিশন রিপোর্ট দেবে। আসলে রোহিঙ্গা প্রশ্নে সু চির এনএলডি এত বেশি নেতিবাচক অবস্থান নিয়ে বসে আছে, যা দেশটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করার পথে দৃশ্যত একটা অন্তরায় হয়ে আছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রায় সর্বদাই বন্ধুর ও যথেষ্ট কণ্টকিত। তাই বাংলাদেশের নীতি হবে এই ইস্যুকে যথাসম্ভব এক পাশে সরিয়ে রেখে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অন্য আর সব ক্ষেত্রে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বিস্তৃত করা।
মিয়ানমারের মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের একটি আসা-যাওয়ার সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। আবার বাংলাদেশ মহিলা সমিতি আরাকানের মহিলা সমিতিকে বাংলাদেশে শুভেচ্ছা সফরে আমন্ত্রণ জানাতে পারে। কোনো সন্দেহ নেই, নিকট প্রতিবেশী হিসেবে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের অবশ্যই ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রশ্নে তাদের ওপর একটা আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে নীরব অথচ সক্রিয় কূটনীতি চালু রাখতে হবে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়নি। অবশ্য এখানে একটা বাড়তি চ্যালেঞ্জ হলো দিল্লির মতো ইয়াঙ্গুনের কাছ থেকে ততটা স্বতঃস্ফূর্ততা না-ও মিলতে পারে। আমরা আশা করব, উন্নয়ন অংশীদারেরা বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নেবে এবং তারা মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াবে, যাতে ‘বিদেশে অবস্থানরত’ রোহিঙ্গা বলে দাবিদার শরণার্থীরা জাতিসংঘের উদ্বাস্তু হাইকমিশনের সহায়তায় অবিলম্বে ফিরে যেতে পারে। অন্তত তেমন একটি পথ সু চিকে খুলে দিতে হবে।
বাংলাদেশ আগামী এক বছর পরবর্তী কমিশন রিপোর্টের ফলাফল বা অনির্দিষ্টকাল ধরে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিতে সক্ষম নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুরব্বিরা, যারা আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারকে আন্তসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ বা উগ্র জঙ্গিবাদ দমনে ‘সর্বাত্মক’ সহযোগিতা দিচ্ছে বা দেওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করছে তাদের কাছে অনুরোধ, তারা রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রাখতে দেওয়ার সম্ভাব্য বিপদ যথাযথভাবে অনুধাবনে যেন খুব বেশি দেরি না করে ফেলে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমার এমনই ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে, যা আপাতদৃষ্টিতে এখন শুধু বাংলাদেশের একার সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু কারও একার সমস্যা না-ও থাকতে পারে। সু চি প্রশাসনকে দ্রুত বুঝতে হবে যে তারা দলিল–প্রমাণ ব্যতিরেকে এমন একটি নীতি অনুসরণ করছে, যা যুগপৎ বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক। তা কেবল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আন্তসীমান্ত র্যা ডিকালাইজেশনের ধারাকে বেগবান করতে পারে। আর তাকে ঘটতে দিলে তা আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতির জন্য হুমকি হিসেবে গণ্য হবে।
বিশ্বনেতাদের বিবেচনায় নিতে হবে যে আইএস যদি তঁাদের সামরিক শক্তির কাছে পরাভূত হয়ে, তাদের ‘খিলাফত ও ভূখণ্ড’ হারায়, তাহলে তাদের সদস্যরা বিশ্বের ‘নরম জায়গাগুলোতে’ ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখাবে। বাংলাদেশ তেমনই একটি ‘নরম জায়গা’য় পরিণত হবে কি হবে না, তা তাঁদের বিবেচনায় নিতে হবে। অন্তত তেমনটা হওয়ার আশঙ্কাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করার একটা গরজ ও গুরুত্ব তাঁদের তরফে প্রত্যাশিত। আর ধারাবাহিকভাবে উদাসীন থাকাটা তাঁদের জঙ্গিবাদবিরোধী সংকল্পের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলেই মনে হতে পারে। রোহিঙ্গা বিশ্বের আর দশটা আটপৌরে উদ্বাস্তু সংকট নয়। এই সমস্যাকে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার হিসেবেও দেখা ঠিক হবে না।
মিয়ানমার একটি অসাধারণ রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এটা এই মুহূর্তে একটি জগদ্দল পাথরের সামরিক শাসন
থেকে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রে উত্তরণের চলমান ল্যাবরেটরি। এর ফলাফল কী হয় তা হলফ করে বলা হয়তো যে কারও পক্ষেই কঠিন। তবে
এখন এটুকুই বলব, আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক যেকোনোভাবেই হোক, কফি আনানের আরাকান কমিশনের কাছে বাংলাদেশের বক্তব্য তুলে ধরতে হবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]

সুত্র: প্রথম আলো

পাঠকের মতামত

আসলে কি বয়কট করছি!

আমরা বাঙালি নতুন ইস্যু পেলে দৌড়ে তা দেখার জন্য উৎকণ্ঠা প্রকাশ করি। আজ বয়কট নিয়ে ...